
১৮০তম বছরে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ পা দিল; ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ঢাকা কলেজ; ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজটি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকে দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন, ওপরে বড় করে লেখা আছে, ‘ Know Thyself- নো দাইসেলফ’; অর্থাৎ ‘নিজেকে জানো’; বিগত ১৮০ বছরে নিজেকে জানার প্রত্যয়ে এই বিদ্যাপীঠে পা রেখেছেন লাখো লাখো শিক্ষার্থী; ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ই নভেম্বর তারিখে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেব ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ঢাকা কলেজ
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নতুন কোন শিক্ষানীতি প্রনয়ণ বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এ দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিলো; অবশেষে ১৮৩০-এর দশকে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে এবং সে নীতিমালায় যে শিক্ষানীতির প্রচলন হয়েছিলো, তা মূলত পাশ্চাত্য বা ইংরেজি শিক্ষা নামে পরিচিতি পায়।
পরবর্তীকালে, ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলো; যেখানে বলা হয়েছিলো “সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।”
স্পেস স্টেশনের ক্যামেরায় ধরা পড়া পৃথিবীর ভুতুড়ে আলো (ভিডিও)
পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের নিকট এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হয়; তখন ঢাকার সেসময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার (Dr. James Tailer) জানান যে, “এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) খুব সহজে পাওয়া যাবে।” ; মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিলো ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়; যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলের নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল।
কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়; তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত ব্যবস্থাপনার ভিত্তি; সে অর্থে জে. আয়ারল্যান্ডই ঢাকা কলেজের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক; তিনি কলেজের শিক্ষাদান ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
২০৬৪ সালের মধ্যে আমাজন বন বিলিন হতে পারে !
ছাত্র হোস্টেলের ইতিহাসে ঢাকা কলেজ
ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা কলেজে পড়তে আসা ছাত্রদের তথ্য প্রথম পাওয়া যায় ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। সেবছর কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায় যে, ১৫জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়; এদের মধ্যে ৭জন ফরিদপুর, ২জন বরিশাল, ২জন যশোহর, ২জন ময়মনসিংহ এবং এমনকি ২জন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকেও এসেছে।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় বাংলা সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে “রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল” নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়।
বন্ধ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছেমতো বয়স কমানো
পরবর্তীতে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্যতম স্থাপত্যবিদ পি. ডব্লিউ. ডি. কর্তৃক ২০X১৪ ফুট আয়াতাকারভাবে প্রতিঘরে ৪জন করে থাকতে পারবে এমন একটি নকশা পেশ করা হয়; এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় হোস্টেলের নামকরণ করা হয় “সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল” ; ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এখানেই বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের একাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেল রূপান্তরিত হয়ে হয় ঢাকা হল; যা বর্তমান শহীদুল্লাহ হল এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল, যা বর্তমানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।
১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি ভাইসরয় লর্ড কার্জন ন্যাথনিয়েল কার্জন ঢাকায় এসে কার্জন হলের উদ্বোধন করেন যা ১৯০৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ করে; ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এটি ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে;
তবে শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, কার্জন হল মূলত ঢাকা কলেজের নতুন ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ভবনটি বিজ্ঞান বিভাগের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং এখনো এভাবেই চলছে; বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যখন এই কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখান থেকে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন; ১১২ বছর ধরে ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কার্জন হল।
১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ বর্তমান জায়গায় চলে আসে; ২৪ একর জমির ওপর ছিল ঢাকা কলেজ; তবে এরশাদ সরকারের সময় ৬ একরর জমি ছেড়ে দিতে হয়; ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজটি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
আমাদের মহাকাশে গোপন ‘সুপার-হাইওয়ে নেটওয়ার্ক’
করোনাকালে অনলাইন ক্লাস
২০২০ সালে করোনার প্রকোপ যখন শুরু হলো, ১ এপ্রিল থেকেই অনলাইনে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করেছিল ঢাকা কলেজ। ১৮০তম বছরে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ
অনলাইন ক্লাস প্রসঙ্গে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও কলেজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে।
এখন পর্যন্ত এইচএসসি পর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে ৪ হাজার ৫৮টি; স্নাতক পর্যায়ে ১১ হাজার ৯৪২টি। ঢাকা কলেজের ফেসবুক পেজ এতটাই সচল ছিল যে ভিডিওগুলো ৫৫ লাখের বেশি মানুষ দেখেছে।
বিজেএসসি’র সহকারী জজ নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
ইউটিউব চ্যানেলে গত এক বছরে ক্লাসগুলো ১১ লাখ ৪৩ হাজারের বেশিবার দেখা হয়েছে; ’ ডিজিটাল স্টুডিওতে শিক্ষকেরা ক্লাস নেন বলে অধ্যক্ষ জানান।
ঢাকা কলেজ ভবন। আলোকচিত্রী: ফ্রিটজ ক্যাপ (১৯০৪)উৎস: ব্রিটিশ লাইব্রেরি
স্মৃতিতে কৃতীরা- ঢাকা কলেজ
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল প্রথম সারিতে; ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হন।
এ ছাড়া ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান জড়িয়ে আছে। ১৮০তম বছরে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ
ভূয়া নিবন্ধন সনদে শিক্ষকতার অভিযোগ
ঢাকা কলেজে এখন পর্যন্ত ৭৩ জন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; এর মধ্যে ড. টি ওয়াইজ, ডব্লিউ ব্রেনাড, ডব্লিউ বুথ, এফ সি টার্নার, এ জে আর্চিবল্ড এবং ড. পি কে রায় অন্যতম;
এ ছাড়া শওকত ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আবু রুশদ মতিনউদ্দিন; আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও এ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন;
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের তালিকায় আছেন খান বাহাদুর বজলুর রহিম, চট্টগ্রাম বিভাগের স্কুল পরিদর্শক আবদুল আজিজ, কলকাতার অতিরিক্ত প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট জাহেদুর রহমান; ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নিবন্ধক নাজিরউদ্দীন আহমদ, লেখক হুমায়ূন আহমেদসহ বহু নামী রাজনৈতিক, খেলোয়াড় ও সরকারি আমলা;
সহশিক্ষা কার্যক্রম
সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সুনাম রয়েছে; চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ডিবেটিং সোসাইটি, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, বাঁধনের মতো সংগঠনগুলো সব সময় ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখে।
এ ছাড়া রয়েছে মিউজিক স্কুল, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব, বাংলাদেশ ওপেন সায়েন্স অর্গানাইজেশন, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, নেচার স্টাডি ক্লাব, ভূগোলবিদের বাসা, এনভারজিও সোসাইটি বাংলাদেশ, কাউন্সেলিং সেন্টার ও মেডিকেল সেন্টার লিটারেরি ক্লাব।
কার্টেসীঃ– প্রথম আলো